ArabicBengaliEnglishHindi
scriptForHost

তেল নিয়ে তেলেসমাতি না কি সাশ্রয়


প্রকাশের সময় : সেপ্টেম্বর ৪, ২০২২, ৯:৪১ অপরাহ্ন / ১০
তেল নিয়ে তেলেসমাতি না কি সাশ্রয়

শংকর রায় ->>
২০২১ সালের শেষের দিকে যখন বিশ^ব্যাপী করোনা অতিমারির প্রভাব কমতে শুরু করে তখন থেকে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব দেশের সরকার করোনা অতিমারি সৃষ্ট বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা থেকে বেরিয়ে আসার জন্যচেষ্টা করে যাচ্ছে।

 

মসজিদ নির্মাণ কাজে আর্থিক সাহায্যের আবেদন

 

যদিও করোনা মহামারির কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি তেমন বড় ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। তারপরেও যেটুকু ক্ষতি হয়েছিল সেখান থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করে যাচ্ছিল সরকার। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু ২০২২ সালের ফেব্রয়ারি মাসে যখন রাশিয়া এবং ইউক্রেনের যুদ্ধশুরু হয় তারপর থেকে পুনরায়বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা দেখা যায়। বিশেষত রাশিয়া কর্তৃক পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্রেতেল এবং গ্যাসের সরবরাহ কমিয়ে কিংবা বন্ধ করে দেওয়ার ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়।

আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে আমদানিকৃত পণ্যের কিছুটা মূল্যবৃদ্ধি পরিলক্ষিত হয় এই বছরের শুরুর দিকে। নিত্যপ্রয়োজনীয় মূল্যের দাম বেড়ে যাওয়াটা ইউক্রেন এবং রাশিয়ার যুদ্ধের ফলে হয়েছিল তার চেয়ে বেশি হয়েছিল দেশের একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীর মুনাফাকেন্দ্রিক মানসিকতার জন্য। তারা চেষ্টা করেছিল এই যুদ্ধের বিষয়টিকে পুঁজি করে বাজারে একটা অস্থিরতা তৈরি করে একদিকে মুনাফা করতে এবং অন্যদিকে সরকারকে সমালোচনার মুখে ফেলতে।

পরবর্তী সময়ে সরকারের শক্ত বাজার পর্যবেক্ষণের ফলে সেসব পণ্যের মূল্য দ্রুত নিয়ন্ত্রণে চলে আসে, যদিও বাজারে মূল্যস্ফীতি অন্যান্য সময়ের তুলনায়বেশি রয়েছে। পরে, আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রমবর্ধমান জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির ফলে যে বিষয়টি আলোচিত হচ্ছিল তা হলো দেশে যেকোনও সময় তেলের মূল্য বৃদ্ধিপেতে পারে। সরকার প্রথম কয়েক মাস এক্ষেত্রে ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে জনগণকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু গত কয়েক মাসেই ভর্তুকি বাবদ প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়েছে সরকারকে।

ফলে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে এই ভর্তুকি কতদিন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব সেটিই বিবেচ্য বিষয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত ৫ আগস্ট সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে। ডিজেল এবং কেরোসিনের মূল্য প্রতি লিটার ৮০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১১৪ টাকা করা হয়েছে। অন্যদিকে পেট্রোলের মূল্য ৮৬ টাকা থেকে ১৩০ টাকা করা হয়েছে এবং অকটেনের মূল্য ৮৯ টাকা থেকে ১৩৫ টাকা করা হয়েছে। তেলের এই মূল্যবৃদ্ধি জনগণের জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে একটি বাড়তি চাপ তৈরি করবে- এ কথা অস্বীকার করার কোনও উপায়নেই।

তবে আমাদের যে বিষষটি গুরুত্বের সাথে ভাবা দরকার সেটি হচ্ছে, কেন সরকার বাধ্য হলো তেলের মূল্যবৃদ্ধি করতে? তেলের এই মূল্য বৃদ্ধির সাথে কি ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধে কোনও সম্পর্ক রয়েছে? এই প্রশ্নে উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের অবশ্যই আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে।

 

মসজিদ নির্মাণ কাজে আর্থিক সাহায্যের আবেদন

 

২০২২ সালের ২ আগস্টে সোনালী ব্যাংকের মার্কিন ডলারের বিনিময় হারকে (৯৪.৭৫ টাকা) বিবেচনায় নিয়ে যদি আমরা অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের তেলের মূল্য তুলনা করি তাহলে দেখা যাবে, বাংলাদেশে মূল্য সবচেয়ে কম ছিল। উদাহরণ স্বরূপ আমরা যদি ডিজেলের মূল্যের কথা চিন্তা করি তাহলে দেখবো, ভারতে প্রতি লিটার ডিজেল ১১০.৯৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে যেখানে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে এর মূল্য ৮০ টাকা। অর্থাৎ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ডিজেলের মূল্য ব্যবধান ৩০.৯৫ টাকা ছিল। মিয়ানমারে প্রতি লিটার ডিজেলের মূল্য ১১২.৫৬ টাকা, যা বাংলাদেশ থেকে ৩২.৭০ টাকা বেশি। চীনে প্রতি লিটার ডিজেলের মূল্য ১১৮.৬৩ টাকা, যা বাংলাদেশ থেকে ৩৮.৩৬ টাকা বেশি। অন্যদিকে, আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে অকটেনের মূল্যের পার্থক্য যদি তুলনা করি তাহলে দেখা যাবে মিয়ানমারে প্রতি লিটার অকটেন বিক্রি হয়েছে ৯৯.৩০ টাকা, যা বাংলাদেশে ছিল ৮৯ টাকা। অন্যদিকে, ভারতীয় বাজারে অকটেনের মূল্য ছিল ১২৩.৬৫ টাকা পয়সা অর্থাৎ বাংলাদেশের চেয়ে ৩৪.৬৫ টাকা বেশি। নেপালে প্রতি লিটার অকটেন বিক্রি হচ্ছে ১৩০.৫৫ টাকায় অর্থাৎ বাংলাদেশের চেয়ে ৪৫.৫৫ টাকা বেশি। চীনে প্রতি লিটার অকটেন বিক্রি হচ্ছে ১৩০.৯৯ টাকা, যা বাংলাদেশের চেয়ে ৪২.৯৯ টাকা বেশি। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এক লিটার জ্বালানি তেল বিক্রি হচ্ছে বাংলাদেশের মুদ্রায় ১৩৫ টাকায়। ফ্রান্সের প্যারিসে প্রতি লিটার অকটেন বিক্রি হচ্ছে বাংলাদেশি মুদ্রায় ২২০ টাকায়, পেট্রোল বিক্রি হচ্ছে ২৩০ টাকায় এবং ডিজেল বিক্রি হচ্ছে ২২৪ টাকায়।

অর্থাৎ এই যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের মূল্য অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে- এ বিষয়েকোনও সন্দেহ নেই। ফলে এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, গত ৫ আগস্ট পর্যন্ত অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের সরকার ভর্তুকি দিয়েতেলের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করে রেখেছিল। ফলে, আমাদের সবাইকে মাথায় রাখতে হবে যে সরকারের পক্ষে ভর্তুকি দিয়ে মাসের পর মাস তেলের মূল্য কম রাখা সম্ভব নয়। ইতোমধ্যে আমরা লক্ষ করেছি, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ পড়ছিল। যদিও জুলাই মাসের রেমিট্যান্সের ইতিবাচক প্রভাব বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে পুনরায় ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে তেলের মূল্যবৃদ্ধি করা ছাড়া সরকারের পক্ষে কঠিন হয়ে যাবে দেশের সার্বিক অর্থনীতির গতি ধরে রাখা। ফলে সরকার তেলের মূল্য বৃদ্ধি করেছে।

তবে এ কথা ঠিক, তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে স্বাভাবিকভাবে মানুষের জীবনযাত্রায় বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামবেড়ে গেছে। অন্য যে বিষয়টি বর্তমানে আলোচনায় রয়েছে সেটি হচ্ছে লোডশেডিং এবং বিদ্যুৎ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সাশ্রয়ী হবার সরকারি নির্দেশনা। এখন প্রশ্ন হলো, এই নির্দেশনা কি শুধু বাংলাদেশ সরকারই প্রদান করেছে? এই প্রশ্নের উত্তর হলো, না। ইউক্রেন ও রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বের বিভিন্নদেশে তেলের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে, অন্যদিকে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে গেছে। এপির তথ্য অনুযায়ী, ইউরোপের বেশিরভাগ দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যাওয়ায় জনগণকে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী হবার আহ্বান জানানো হয়েছে সরকারের পক্ষথেকে। ফ্রান্সে মধ্যরাতের পর রাস্তায় সব লাইট বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। ইউরোপের দেশগুলোতে শীতের প্রভাবে মানুষ গরম পানি ব্যবহার করে। ফ্রান্সে সব বাসায় গরম পানি ব্যবহার না করতে আহ্বান জানানো হয়েছে।

অর্থাৎ, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে সৃষ্টবৈশ্বিক অর্থনীতির মন্দা মোকাবিলা করতে বিভিন্ন দেশ হিমশিম খাচ্ছে। সেদিক থেকে চিন্তা করলে বাংলাদেশ অনেক শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে এখন পর্যন্ত। এই মুহূর্তে অর্থনীতির গতিপথ ঠিক রাখতে সরকারকে তেলের মূল্য বৃদ্ধিসহ কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেই হয়েছে। তবে এ কথা ঠিক, সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সংস্কারের কারণে জনজীবনে কিছুটা দুর্ভোগ নেমে আসবে। তবে দেশের স্বার্থে আমাদের সবাইকে এই সময় যৌক্তিক আচরণ করতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে চলমান লোডশেডিং এবং বিদ্যুৎ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সাশ্রয়ী হবার জন্য সরকারের তরফ থেকে যে আহ্বান জানানো হয়েছে, অনেকেই তার সমালোচনা করছেন এই মর্মে যে সরকারের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা নেই।

 

মসজিদ নির্মাণ কাজে আর্থিক সাহায্যের আবেদন

 

সমালোচনাকারীদের মনে রাখা উচিত, ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কী অবস্থা ছিল? দেশে ১২ ঘণ্টার ওপরে লোডশেডিং থাকতো। সেই সময়ে সরকারের সক্ষমতা ছিল না বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে। সেই সময়ের রাজনৈতিক দলের নেতাকে আমরা বলতে শুনেছি বাংলাদেশের মতো কোনও দেশের সরকারের পক্ষে বাসা এবং বাইরে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব নয়। কিন্তু শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার এটি প্রমাণ করে দেখিয়েছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষমতা অর্জন করা সম্ভব। বাংলাদেশে এখন যে লোডশেডিং হচ্ছে তা বিদ্যুৎ উৎপাদনের অক্ষমতার কারণে নয়, এটি হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে।

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে দেশের অর্থনীতিকে কখনও কখনও চড়াই-উতরাই পার হয়ে এগোতে হয়। এবারও ঠিক তা-ই হয়েছে। ইউক্রেন ও রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দার ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব আমরা লক্ষ করছি।

এতে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বে দেশ খুব দ্রুতই সব সমস্যার সমাধান করে পুনরায় অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছে যাবে।