scriptForHost

যে স্মৃতি ভোলা যায় না


Daily Jonotar Bangla প্রকাশের সময় : জানুয়ারী ২৩, ২০২২, ৭:৪৩ অপরাহ্ন /
যে স্মৃতি ভোলা যায় না

-আবু জাফর বিশ্বাস

একবিংশ শতাব্দীর ভার্চুয়াল ডিজিটাল যুগের এই দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে দু’চোখে চারিদিকে যখন দেখি শুধু ইটপাথরের বহুতলা দালান-কোঠা, পায়ের নিচে কংক্রিট, পিচ ঢালা রাস্তাঘাট, আর বুকভরে দম নিতে গেলে শুধুই ধুলা-ময়লা ও বিষাক্ত ধোঁয়া; তখন অতীত দিনের সেই স্মৃতি কথাগুলো খুব মনে পড়ে যায়। যেখানে ছিল চারিদিকে শুধুই সবুজ আর সবুজ, নৈসর্গিক অপরূপ দৃশ্য। বুকভরে শ্বাস নিলে শুধুই বিশুদ্ধ বাতাস, অক্সিজেন। এক একটা শতবর্ষী গাছ ছিল যেন এক একটা অক্সিজেন ফ্যাক্টরি। খেলাধুলার জন্য ছিল পর্যাপ্ত মাঠ, বিস্তীর্ণ পতিত জমি, খড়ের ভূই, বড় বড় আম-কাঁঠালের বাগান। শিতের শেষে সারা মাঠ ফাঁকা, যেন সব বল খেলার মাঠ। গরু ছাগল মাঠে থাকতো এড়া। সারা মাঠে খেলেছি কত যে খেলা! বর্তমান আমরা সবাই যেন যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছি, কিসের নেশায় যেন শুধু ছুটছি আর ছুটছি। কারো কোন অবসর নেই, নেই আগের মত বিনোদন, নেই সেই খেলাধুলা, আর খেলার মাঠ। শুধু খেলার মাঠ নয়; এমন কী ফসলের জমিও প্রায় সব হারিয়ে যাচ্ছে। গড়ে উঠছে বড় বড় ইমারত। তাই অতীতের সেই খেলাধুলার আর সুযোগ নাই, আজ আমাদের বাচ্চারা সেগুলো চেনেই না। তাই সময় এসেছে আমাদের বর্তমান শিশু-কিশোর ও আগামী প্রজন্মকে নিয়ে ভাবার। শুধু মোবাইলে গেম খেলা নিয়ে বসে থেকে তাদের কর্ম স্পৃহা এবং কর্মক্ষমতা লোপ পাচ্ছে। এদের শরীর চর্চা দৈহিক বৃদ্ধি ও মেধা বিকাশের জন্য সুযোগ করে দিতে হবে খেলাধুলার এবং ফিরিয়ে আনা দরকার আমাদের ঐতিহ্যবাহী সব খেলাগুলো। বোঝাতে হবে আমাদের বাঙালীর নিজস্ব সংস্কৃতি। গ্রাম বাংলার কত উৎসব এখন আর দেখাই যায় না। সেই জারি-সারি, পালা গান, প্রেণী গান, সুরে সুরে পুথি কিতাব পাঠ এখন আর শোনাই যায় না। বৈশাখী নববর্ষ উৎসব ছাড়াও ছিল হেমন্তের নবান্ন উৎসব। নতুন আমন ধান উঠলে গুঁড়ো কুটে বিভিন্ন রকম পিঠা, আর নতুন খেজুরের গুড়, আহ! মনে করলেই জিহ্বায় জল এসে যায়! আবার যখন চৈত্রের খাঁখাঁ রৌদ্র, চারিদিকে নেই ধান পাট, শুধু ধুধু মাঠ, বৃষ্টির জন্য সবাই গর্ত কেটে তাতে পানি ঢেলে কোলা ব্যাঙ ছেড়ে দেয়া হতো, আর সবাই কাদা-পানি মেখে; কাদাখেই করে গান ধরা হতো- আল্লাহ মেখ দে পানি দে ছায়া দে-রে তুই আল্লাহ…। তারপর বাড়ী বাড়ী চাল তুলে খির রান্না করে খাওয়া হতো। কোনদিন সত্যিই যেন ঈশান কোণে কালবৈশাখীর মেঘ গুড়গুড় করে ডেকে বৃষ্টি নেমে আসতো। তখন আমাদের আনন্দে বুকটা ভরে যেত। মৃত্তিকা আবার ফিরে পেতো যেন তার পুনর্জীবন, উর্বর মাটিতে গাছগাছালি হতো সবুজ সতেজ। সেই নির্মল প্রকৃতি এখন আর নাই, সব কিছুই আজ পরিবর্তন। সেই বড় বড় বৃক্ষও আর নাই। এদিকে ইটের ভাটার কালো ধোঁয়ায় বাতাস হচ্ছে দূষিত, যানবাহনে হচ্ছে শব্দ দূষণ, পলিথিন ব্যাগে পরিবেশ হচ্ছে দূষণ, নদী ভাঙনে কমছে আবাদি জমি, ডিপ-স্যালোয় বাড়ছে ভূগর্ভস্থ পানির চাপ, ওদিকে গ্রিনহাউজ ইফেক্ট। এসব কিছুর কারণে পরিবর্তন আসছে আমাদের চিরসবুজ প্রকৃতিতে। এখন পরিবেশের এই বিপর্যয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কম বৃষ্টি, অনা বৃষ্টি, তাপদাহ উষ্ণ আবহাওয়া, এ ব্যাপারে আমাদের স্বচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। অধিক পরিমানে গাছ লাগাতে হবে, ধরে রাখার চেষ্টা করতে হবে পরিবেশের ভারসাম্য। নতুন সৃষ্টির প্রত্যয় নিয়ে স্বপ্নভরা আগামী দিনগুলো হোক চিরসবুজ সুন্দর ও সুখের।

আগের দিনের বেশ কিছু খেলার নাম এখন এই নতুন প্রজন্ম জানেই না। আমাদের জাতীয় খেলা হা-ডু-ডু, সেটাও এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। তখনকার উল্লেখযোগ্য কিছু খেলার নাম আমি মনে করতে চাই, যেমন- হাডুডু খেলা, বল খেলা, গাদি খেলা, লাঠিখেলা, গোল্লাছুট, বুড়ি চুঁ, মার্বেল, ডাংগুলি, কিতকিত, কানা-মাছি, বাঘ বন্দি। কড়ি সারা, গুটি খেলা, ইচিং বিচিং, গুলতি বন্দুক, তির ধনুক, পটকা ফুটানো, ঘুড়ি উড়ানো, লাঠিভরে হাঁটা, সাঁতার কাটা, কলার ভেলা, ইত্যাদি। এছাড়া শীতকালে সন্ধ্যার পরে খেজুর গাছের ছোবড়া দিয়ে মশাল বানিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে ঘুরাতে ঘুরাতে দৌড়ান। এমন কত যে খেলা, সে আনন্দ অনুভূতির কথা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। সেই স্মৃতিমাখা গ্রামবাংলার দিনগুলির কথা এখন খুব মনে পড়ে।
—–
আমরা ছোটবেলা যখন কোনদিন স্কুলে যায়নি; তখনও কিছু ইংরেজি জানতাম! সেটা হলো মার্বেল খেলতে গিয়ে যখন গদখেলা করতাম, বলতাম- স্টেট, নট স্টেট, ক্রীজ, নট ক্রীজ, মাই সাইড, উড্ডীন, হোল্ড, গদে গেলে নট গহ্বর, ইয়েস, নো, ভেরি গুড, এমন। এই সব শব্দের মানে তখন জানতাম না, তবে বুঝতাম। মনে হতো সব বাংলা। আবার যখন গোল্লাছুট খেলতাম, কিছু উর্দু বলতাম। কে কোন দলে খেলবে তা নির্ধারণ করতাম এভাবে- দুজন করে গোপনে রুপক নাম পাতিয়ে নিয়ে আসতো, প্রথমে সামনে এসে বলবে- :উঝকো মুঝকো কিছকো ডাক? দলনেতা- :হাম মারি তোমকো ডাক। তার পর ওই দুজন পাতানো নাম বলবে যেমন- :কে নিবে আকাশ? কে নিবে বাতাস? একজন নাম ডাকবে আমি নিব আকাশ, এবার যার গোপন নাম আকাশ সে তার দিকে চলে যাবে।

আরো এক রকম ছিল, এসব খেলা এখন আর গ্রামগঞ্জেও দেখা যায় না, সেই অতিত গুলো এখন শুধুই স্মৃতি। সেটা হলো- দলনেতা দুজন তাদের চার হাত ধরে সামনা-সামনি দাড়াবে, আর সবাই ঘাড়ে হাত বেঁধে লাইন দিয়ে হাতের ভিতর দিয়ে যেতে থাকবে। এসময় দলনেতাদ্বয় নিচের ছড়াটি পড়বে, পড়ার শেষ শব্দটা উচ্চারণ করার সাথে সাথে যে হাতের ভিতর আটকা পড়বে সেই একদিকে এসে বসবে। ছড়াটি হলো এই-
ও পন্টি বাক্সো, রাইট এন্ড টেক্সো।
চুলটানা বিবিয়ানা, সাহেব বাবুর বৈঠকখানা।
কাল বিলেতে যেতে, পানের তামুক খেতে।
পানের মধ্যে মৌরিবাটা, ইসকাপনের ছবি আটা।
আমার নাম রেনু বালা, চলে যাব যশোর জেলা।
কলকাতা মাথা ঘসা, বেলফুল আর চিরনি;
এটে খোঁপা বেঁধে দিব, ফুলের মালা গাঁথুনি।।
———